গল্পঃ কিছু ভুলের মাশুল হয় না। ( দ্বিতীয় এবং শেষপর্ব ) | Story: Some mistakes are not charged. (Second and final episode)

গল্পঃ কিছু ভুলের মাশুল হয় না।  ( দ্বিতীয় এবং শেষপর্ব ) | Story: Some mistakes are not charged. (Second and final episode)

 
                                            গল্পঃকিছু ভুলের মাশুল হয় না।

                                                            ( দ্বিতীয় এবং শেষপর্ব )
 
মিম আশে পাশে তাকিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা আলতো টেলে ভেতরে ঢুকতেই মারুফ দরজা একেবারে বন্ধ করে দিলো। তারপর হ্যাচকা টানে মিমকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে ঠোঁট ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করতেই মিম তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাঁধা দিলো….
— কী করছো তুমি মারুফ ! 
 
— প্রতিদিন যা যা করি সেটাই। নতুন কি? তুমি কি সাধু সন্নাসী দলে নাম লিখিয়েছো ইদানিং। নাকি পতিভক্তি রমনী হয়ে গেলে।
মিম নিজেকে ছাড়িয়ে একটু দূরে আসে। 
 
— মারুফ আমি তোমাকে সব বলেছি। আমার স্বামী আমাকে ত্যাগ করেছে। গত তিনদিন থেকে আমি একেবারে ভেঙ্গে পড়েছি। সব জানার পর কোথায় তুমি আমাকে ভরসা দেবে তা না, উল্টো আমার ফোন ধরছো না। আমাকে এড়িয়ে চলছো। কেন করছো এমন ?
— দেখো, আমি ব্যবসা করি। আমার অনেক কাজ থাকে। সব সময় ফোন ধরা সম্ভব হয় না।
— অজুহাত বাদ দাও। আগেও ব্যবসা ছিল তোমার। আমি এসেছি কিছু সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলতে। তারপর আমি চলে যাব। 
 
— সিরিয়াস বিষয় না হয় পরে বলো। আসো আগে একটু আদর করে নেই। মারুফ ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মিমের দিকে। মিম দেয়াল ঘেষে দাঁড়ানোর কারণে আর দূরে যেতে পারে না। মারুফ হ্যাচকা টানে মিমের শাড়ীটা বুক থেকে সরিয়ে দেয়। তারপর অনেকটা পাঁজাকোলা করে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়। দুহাতে শক্ত করে ধরে ঠোঁটের পর ঠোঁট ছুয়ে দেবার চেষ্টা করতে বেশ ধ্বস্তাধস্তি হয় মিমের সাথে। ধ্বস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ফুল হাতা ব্লাউজের খানিকটা অংশ ছিড়ে যায়। মিমের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে দেখে বেশ ঘাবড়ে যায় মারুফ। তক্ষণাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে আসে। আচ্ছা তুমি যাও আজ।
মিম নিজের কাপড় ঠিক করে উঠে দাঁড়ায়। 
 
— মারুফ আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। এই তিন বছরে আমি এতোটাই দূরে এসে গেছি যে সেখান থেকে ফেরা বেশ কঠিন। একদিকে আমার স্বামী আমাকে ফেলে চলে গেছে। আর তুমি যদি এমন করো, তখন মরা ছাড়া আমার কোন পথ থাকবে না।
— কী বলবে স্পষ্ট করে বলো মিম। আমাকে যেতে হবে। মিটিং আছে ক্লাইন্টের সাথে।
— আমাকে তুমি অনেকবার সারাজীবনের জন্য পেতে চেয়েছো। বলেছো রাজ রাণী করে রাখবে। তুমি বলেছো আমার মত এজীবনে কেউ তোমাকে ভালবাসে না। এখন সময় এসেছে কথা রাখার। মারুফ তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে। 
 
— কী বলছো তুমি।। পাগল হলে। তুমি জানো আমি বিবাহিত। আমার দুটি বাচ্চা আছে।
— না না, ওদের ছাড়তে হবে না। তোমার বউ থাকুক। আমাকে শুধু স্বীকৃতি দাও। যখন তোমার মন চাইবে আমার কাছে আসবে। আমি কিচ্ছু বলব না। বাবা মা যদি জানে, আমার ভুলের জন্য স্বামী আমাকে তালাক দিচ্ছে। তবে আমাকে বাসায় রাখবে না। প্লিজ মারুফ তুমি আমাকে বিয়ে করো। আমাকে বাঁচতে দাও। নাহলে হয়ত আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। 
 
— দেখো মিম, এটা সম্ভব না। আমি একটা সমাজে বসবাস করি। ব্যবসার জন্য সমাজে অনেকের সাথে আমার উঠাবসা। আমার যা সম্মান আছে সেটা শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার বউ মিতু কিছুটা টের পেয়ে গেছে। এই অল্পতে তার যা রিয়েকশন, শেষ পর্যন্ত কেলেংকারী হয়ে যাবে। আমি এটা করতে পারব না।
— তাহলে এতোদিন যা ছিল সব ভুল ছিলো। কেন তুমি আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছো ? এত ভালবাসার অভিনয় কেন করলে ? শুধু আমাকে ভোগ করার জন্য তুমি দিনের পর দিন আমার শরীর নিয়ে খেলেছো। তুমি শুধু শরীরটাই বুঝলে। 
 
— প্রথম দেখাতেই তোমাকে ভাল লেগেছিল। তুমি যথেষ্ট সুন্দরী। কিছু ভাল লাগলে সেটা পাওয়াটা আমার নেশা। এক জীবনে আমি যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। তবে একা আমি কেবল সুখ পাইনি। তুমিও নিজের প্রয়োজন আমার কাছে মিটিয়েছো। একই পাপে তুমিও পাপী মিম।
— হ্যা হ্যা আমি পাপী। আমি আমার স্বামীর সাথে পাপ করেছি। বাচ্চাদের সাথে পাপ করেছি। বাবা মায়ের সাথে পাপ করেছি। তোমাকে ভালবেসে পাপ করেছি। অনেক অনেক পাপ করেছি। চিৎকার করে কথাগুলো বলতে বলতে হু হু করে কাঁদে মিম। 
 
— দেখো মিম। বাড়াবাড়ি করো না। যা সম্ভব না তা নিয়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করো না। আমি এখন চলে যাচ্ছি। আর শোন আজকের পর থেকে আমাদের সম্পর্ক শেষ। আমাকে আর কোনদিন ফোন দিবা না। এমনকি দেখা করার চেষ্টাও করবা না। 
 
—বাহ ! বাহ ! শেষ পর্যন্ত মুখোশ খুলে ফেললে। আমার এত ভাল একটা স্বামী থেকে আমাকে ছিনিয়ে ভেবেছো তুমি ভাল থাকবে। আমি তোমার বউক মিতুকে সব বলে দেবো। একেবারে ছবি পর্যন্ত দেবো।
— এটা কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি মিম। আমি ছি
নিয়ে আনিনি। নিজের ইচ্ছেতে এসেছো। যা যা করেছো তোমার ইচ্ছায়। আমি জোর করিনি কিছু।
— বাড়াবাড়ির কি দেখছো ! তুমি আমাকে ইমোশনালি ফাঁদে ফেলেছিলে। 
আমি তখন বুঝিনি। তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। এটা অন্যায় ছিল। আর এখন আমার সব শেষ করে তুমি হাওয়া লাগিয়ে বেড়াবে । তোমার তো মেয়ের অভাব নেই। তোমার সেই লাবনী, কনিকা , আরো কে কে যেনো। অহ ! শান্তা। আমিতো তোমার কাছে ইউজ হয়ে শেষ হয়ে গিয়েছি। এখন উল্টো ঝামেলা রাখবে না, তাই না। তোমাকেও আমি ভাল থাকতে দেব না। 
 
— এতক্ষণ ভদ্র ভাষায় বলছি, কানে নিচ্ছো না। আমার আসল রুপ তুমি দেখোনি মিম। এতদিন তোমাকে ইউজ করেছি এটা সত্য। তোমার মত আমার অনেকে আছে এটাও সত্য। আমি জানি তোমার মত বিশ্বাসঘাতক নারীরা একদিন ব্ল্যাকমেইল করবে। যে স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, সে সবার সাথে করবে। এটা জানা কথা। তাই আগেই সব ভিডিও করে রেখেছি। সব এডিট করে আমার চেহারা ঢেকে দিয়ে তোমাকে সুন্দর করে তুলে রেখেছি। এসব ভিডিও, ছবি সব তোমার অসুস্থ বাবা মা, পাড়া পড়শী সবার কাছে যাবে। অনলাইনে ভাইরাল হবে এসব ভিডিও। এটা কি দেখতে চাও তুমি ?
— ছিঃ ছিঃ এত্তটা নীচ তুমি ! 
 
একটা পশুকে আমি এতদিন ভালবাসছিলাম। তুমি মানুষ নামের অযোগ্য। আমি কল্পনা করিনি, তুমি এতটাই খারাপ। লজ্জা হচ্ছে আমার। 
 
— শোন মিম, তুমি আমার বিন্দু পরিমান ক্ষতি করলে, আমি কি করতে পারি তা আশা করি বুঝে গেছো। চুপচাপ বাসায় যাও। আর কোনদিন দেখা, ফোন কোনকিছুই করবে না। মন থেকে সব মুছে দিও। আর পারলে জামাই কাছে মাফ চেয়ে তার কাছে ফিরে যাও। 
 
— প্লিজ মারুফ তুমি একটু সদয় হও। আমার যাবার জায়গা নেই। আমি সত্যি মরে যাব।
আর কোন কথা না মিম । আর হ্যা শোন বড়লোকের এমন অনেক মিম থাকে রক্ষিতার মত। এত স্বপ্ন তাদের দেখতে নেই। একদম চুপ হয়ে থাকো, নাহলে আরেকটা বসুন্ধরার মুনিয়া হতে সময় লাগবে না। আমি গেলাম এখন। কাল আমার সিংগাপুর যেতে হবে ব্যবসার জন্য। আমার ফোন নাম্বার ডিলিট করে দিও। একদিন যদি আর ফোন দিয়েছো, তাহলে ভাল হবে না। 
 
কথাগুলো বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়নি মারুফ। হন হন করে বেরিয়ে গেছে। দাঁড়ানো অবস্থায় থাকা মিম ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। ভাবতে পারে না, কী করে একটা অমানুষকে এতদিন ভালবেসে তার ফেরেশতার মত স্বামীকে ধোঁকা দিলো। 
 
এই মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকাটাই তার জন্য অনেক কঠিন। কেন সে সাময়িক সুখের জন্য চিরস্থায়ী সুখটা বিসর্জন দিলো।
তার ভুলের কি কোন ক্ষমা নেই।
 
শরীরের শক্তিটুকু আস্তে আস্তে হ্রাস পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কয়েক মণ পাথর কেউ শরীরের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে। তার হাত পা কাঁপছে। কেন যেন হাত পা ঠান্ডা অবশ হয়ে আসছে। কোন রকমে উঠে দাঁড়ায়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তবু দেয়াল ধরে ধরে মারুফের ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে আসে। এক দুবার সিঁড়িতে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলো। সিঁড়ির হাতল ধরে কোন রকম নিজেকে সামলেছে।
আস্তে আস্তে বড় রাস্তার মোড়ে কোন রকম আসলো। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে তার এই মুহুর্তে। মাথা ঘুরতে লাগলো। সমস্ত মানসিক যন্ত্রণা তাকে বিধ্বস্ত করে যাচ্ছিলো। বার বার পড়ে যাচ্ছিলো । শরীর ক্রমশ অবেচেতন হয়ে আসছে। একটা মানসিক বিধ্বস্ত মানুষের এমন হতে পারে তখন পর্যন্ত সে বুঝতে পারছে না। সমস্ত চিন্তা ভাবনা তাকে ঘিরে রেখেছে। চিন্তা করতে করতে কখন যে বড় রাস্তার একেবারে মাঝামাঝি জায়গায় চলে আসছিল খেয়াল করেনি। রাস্তাটা এমনিতে প্রচন্ড ব্যস্ত। শোঁ শোঁ করে গাড়ী চলে দু প্রান্ত থেকে। 
 
খেয়াল করেনি, পেছন থেকে অনবরত গাড়ী হরণ দিয়ে যাচ্ছে। ঘুরে তাকায়। দ্রুতবেগে আসা একটা বাসকে সাইড দিতে গিয়ে একটু অন্য পাশে সরে যেতেই হুট করে ধাক্কা লাগে বিপরীত দিকে আসা আরেকটা গাড়ীর সাথে। সাথে সাথে ছিটকে পড়ে যায়। বিপরিত দিক থেকে আসা ট্রাকটি ততক্ষণে জোরে ব্রেক কষে ,আবার দ্রুতবেগে স্থান ত্যাগ করে। ট্রাকের সাথে মিমের ধাক্কা লাগার পর, তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ে মিম। ততক্ষনে জ্ঞান হারায়। এবারের মত পর পর দুদিন জ্ঞান হারায়। মাথায় সম্ভবত প্রচন্ড আঘাত পেয়ে রাস্তার এক পাশে পড়ে থাকে নিথর দেহ। বেশ কয়েক জায়গা থেতলে গেছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে কয়েক জায়গা থেকে। স্থানীয় মানুষজন দৌড়ে ঘটনাস্থলে আসে। ততক্ষণে পালিয়ে যায় ট্রাক।


রাত বারোটার কাছাকাছি নিজের বাসায় ঢুকে মারুফ। মিতুর চোখে চোখাচোখি হতেই খানিকটা স্মিত হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতেই মিতু খেঁকিয়ে উঠে, এত রাতে বাসায় ফিরে অভিনয় করা লাগবে না। তার চেয়ে বরং তোমার ঐ মিমের কাছে যাও।
তুমি কি পাগল হলে মিতু। 
 
ও হা, মিমের চ্যাপ্টার তো আজ শেষ করে আসছো। হয়ত নতুন কেউ পেয়ে গেছো। বিয়ের পর থেকে তোমার এই চরিত্র আমার বেসগ জানা আছে। আচ্ছা আরো কে কে জানি তোমার রক্ষিতা আছে। তোমার তো এসবের অভাব নাই। টিয়া ময়না কতজন আছে। 
 
তুমি কোনদিন তো এমন করে কথা বলোনি মিতু। এত বেয়াদব কবে থেকে হলে।
মেয়েরা মুখে মুখে সত্য বললেই বেয়াদব। বাঙ্গালী রমনীদের চুপ করিয়ে রাখার মাঝে তোমাদের বেশ স্বার্থকতা। তবে দিন বদলেছে। আর কোনদিন বলিনি বলে কি আজ বলতে পারব না, এটা তো না। দেয়ালে পিঠ লেগে গেলে কিছুই করার থাকে না মামুন সাহেব। 
 
শুনো তোমার সাথে আমার আজাইরা প্যাচালের সময় নাই। আমি এখন ঘুমাবো। ভোরে আমার ফ্লাইট সিংগাপুরের। 
 
বাহ ! তো- জনাব এবার কাকে নিয়ে যাচ্ছেন। কোন মিডিয়া সেলিব্রেটি নাকি টিয়া-ময়না নতুন কেউ পেলে। 
 
মুখ সামলে কথা বলো। এত রাতে সিনক্রিয়েট করো না প্লিজ। মুখের লাগাম দাও মিতু।
তোমার কি ধারণা, আগের সেই বউদের মত সব জ্বি জ্বি করব। তোমার সমস্ত অনিয়ম দিনের পর দিন মেনে যাব। তুমি ধমক দেবে আর আমি আগের মত চুপ হয়ে যাব। এতদিন কথা বলিনি। যা বলেছো মেনে নিয়েছি। ভেবেছি বাচ্চা কাচ্চা বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কৈ তোমার তো ঠিক হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। 
 
এত অদ্ভুদ খবর তোমাকে কে দেয় ? কে তোমাকে এসব লাগিয়ে বেড়ায় ?
কেন? বিশিষ্ট শিল্পপতি মারুফ সাহেবের গোয়েন্দা থাকতে পারলে তার স্ত্রীর এক দুজন কেন থাকবে না।
বিয়ের এতদিন পর আজ নতুন রুপে তোমাকে দেখছি। ব্যাপার কি ? 
এত শক্তি কই থেকে আসলো আজ। তুমি কোনদিন এমন তো ছিলে না মিতু। 
 
নারীরা মমতাময়ী। ভাল হওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিলাম, হওনি। বরং তোমার নষ্টামি দিন দিন বেড়েছে। আমাকে কি বাচ্চা দেখার জন্য রেখেছো। কয়দিন আমার সাথে ভাল করে কথা বলেছো। কয়দিন আমরা একসাথে বিছানায় গেছি ভাল করে। শেষ কবে আমাদের ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছিল, মনে পড়ে তোমার। তবুও একটা মেয়ে শুধু ফিজিক্যাল রিলেশন চায় না। চায় স্বামী তাকে সম্মান করুক, গুরুত্ব দিক, ভালবাসুক। এক বেলা খেলেও সমস্যা নাই। 
 
প্লিজ স্টপ। এত রাতে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না মিতু। 
ভাল লাগলে থাকো, না লাগলে দরজা খোলা আছে। চলে যেও। আমি যেমন আছি তেমন থাকব।
বাহ ! তোমার মত পুরুষ আর কি বলতে পারে। তাদের ধারণা এই কথা বললে, বউয়েরা ভয় পেয়ে চুপ থাকে। হ্যা আমিও চুপ করে যেতাম। কারণ মেয়েদের যাওয়ার জায়গা কম। নিজের ফ্যামিলি যখন বলে মানিয়ে নাও, মেনে নাও তখন একটা মেয়ে ধৈর্য ধরে পড়ে থাকে দিনের পর দিন এই আশায় যে, একদিন স্বামী ঠিক হবে। কিন্তু স্বামী নামক সে বস্তু আর বদলায় না। 
 
আচ্ছা তুমি কি করতে চাও। কাপড় চেঞ্জ করতে করতে মারুফ বলে।
অন্য মেয়ে হলেও আমিও তোমার কথায় ভয় পেয়ে চুপসে যেতাম। এতদিন মানসিক নির্যাতন, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, আমার বাবা মাকে গালাগালি, আমাকে শারিরিক হেনস্থা কি করোনি তুমি। তবুও পথ চেয়ে ছিলাম তুমি ঠিক হবে। হওনি যখন এখানেই ইতি টানবো। বিয়ের পর তুমি আমার জবটা ছাড়তে বাধ্য করেছিলে। আসলে প্রত্যেক মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো থাকলে এমন পর্যায়ে অসহায় হয়ে পড়ত না। আর সব মেয়ে টাকার লোভে পড়ে থাকে না। দরকার হলে না খেয়ে থাকবে তবু আত্ম বিসর্জন সব মেয়ে দেয় না।
বাহ, ইদানিং কথার খৈ ফুঁটেছে। নতুন প্রেমে পড়নি তো?
 
তোমার চরিত্রের সাথে সবাইকে মিলাতে যেও না। এতদিন বাবা মা বলেছিলো, মানিয়ে নাও। এখন আলহামদুলিল্লাহ্‌ তোমার কর্মকান্ড দেখে তারাই বলছে চলে আয়। তাই বাচ্চাদের আগে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর তোমাকে এসব বলার জন্য আমার থাকা। পরে বলবা পালিয়ে গেছি। তাই সত্য উন্মোচন করে যাচ্ছি। সকাল হওয়ার আগেই যাচ্ছি অবশ্য। 
 
আমার বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়ার এত সাহস হল কি করে ?
এতদিন বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ ভেবে চুপ ছিলাম। এখন দেখলাম উল্টো তোমার কারণে বাচ্চারা নষ্ট হবে। আমার জীবনের কথা আর কি ভাববো। বাচ্চাদের কথা ভেবে সাহস করেছি। আমি নিজেই পড়ালেখা জানা মেয়ে। অতএব এদের ভরণ পোষণ অসম্ভব না। এই বাচ্চা তুমি কখনোই পাবে না। এতদিন এডপ্টের কাগজ রেডি করেছি। তোমার কিছু বলার থাকলে আদালতে বলো। বাদ বাকী কথা আদালতে হোক। আদালত যদি মনে করে,তোমার যা প্রাপ্য, আই ক্যান ডু ইট। 
 
দুদিন পর বুঝবে। যখন পাশে কেউ থাকবে না। টাকার অভাব বুঝো ? এতদিন তো বুঝোনি। এবার বুঝবে ?
তুমি কি করে বুঝবে ? বিয়ের কয়েকদিন পর থেকে তোমার এসব কর্মকান্ড শুনে আসছি। শুরুর দিকে বিশ্বাস করিনি। এরই মধ্যে দু বাচ্চার মা হয়ে গেলাম। আর খেয়াল করা হয়নি, যে তুমি দিন দিন এতটাই দূরে সরে যাচ্ছো। যখন জানলাম ততক্ষণে তোমাকে ফেরানোর কম চেষ্টা করিনি। ফলাফল কি হলো, উল্টো মানসিক নির্যাতন সইতে হতো । তোমার বাবা মা তোমাকে মানুষ করতে পারেনি আর আমি কি করে করব। টাকার কথা বলছো, সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।
বাহ ! অনেক চালাক হয়ে গেছো। টাকা ও ম্যানেজ আছে। 
 
আমার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল সেটা তোমাকে বলে লাভ নেই। অসংখ্য দিন কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি। কেউ দেখেনি। গত এক বছর থেকে নিজেকে সামলেছি। আস্তে আস্তে নিজেকে ভালবাসতে শুরু করেছি। মানসিক শক্তি সঞ্চয় করেছি। চাকরীর ব্যবস্থা করেছি। যাতে তোমাকে ছেড়ে গেলে অসুবিধা না হয়। প্রত্যেক মেয়ের এভাবেই করা উচিত। আফসোস অনেক মেয়ে তা পারে না। আমি আমার পরিবারকে কাছে পেয়েছি তাই সহজ হয়েছে। 
 
চুপ করো তোমার লেকচার বন্ধ করো প্লিজ। মাথা অনেক ধরেছে। যাও ঘুমাও। কাল এ নিয়ে কথা বলা যাবে। তোমাদের মেয়েদের কথার ঠিক নেই। কাল দেখবে মন বদলে গেছে। 
 
সব মেয়েদের দূর্বল ভাবা ঠিক না। একটা মেয়ের যখন নিজের পরিবার পাশে থাকে, বাবা মা পাশে থাকে, ভাই বোন থাকে তখন সে দূর্বল হয় না। আর হ্যা নেক্সট সপ্তাহ থেকে আমি চাকরীতে জয়েন করছি। সব পাক্কা করে এতদিন রেখেছি। বলতে পারো ডির্ভোসের আয়োজন এতদিন থেকে করে আসছি। ফাইনালি সেটা করতে পারছি বলে শান্তি লাগছে । একটা চরিত্রহীন ভালবাসাহীন কাপুরুষের সাথে সংসার করার চেয়ে একা থাকা ঢের শ্রেয়। 
 
মারুফ কিছুটা চিৎকার করে.. মিতু আমি ভাবতে পারছি না, তোমার এত সাহস হবে। কি করে এতটা বদলে গেলো। এমন তো তুমি ছিলে না। পাগলামি বাদ দাও। ঘুমাতে যাও। কাল এ নিয়ে আমরা কথা বলব মিতু। 
 
আমার কথা বলা শেষ । তুমি ঘুমাতে যাও। আমি হয়ত রাতেই চলে যেতে পারি। কাজের মেয়েকে সব গুছিয়ে বলে দেয়া আছে। আর কেয়ার টেকার রহিম ভাইকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তোমার অসুবিধা হবে না। টিয়া-ময়নাকে নিয়ে থাকো। আর হ্যা মেয়েদের দূর্বল ভেব না। সব মেয়ে ছাড় দেয় না। আর আরেকটা শেষ কথা বলি, আল্লাহ সবাইকে ছাড় দেয় কিন্তু কাউকে ছেড়ে দেয় না। সাবধান হয়ে যাও।
কথাগুলো বলেই রুম থেকে বের হয়ে অন্য রুমে চলে যায় মিতু। 
 
ঘরের মধ্যে অস্থির পায়চারী করছে মারুফ।মিতুর এমন রক্তচক্ষু সে এর আগে কোনদিন দেখেনি। এতদিন সে যা যা বলেছে,বিনা বাক্যে মিতু মেনে নিয়েছে। হুট করে এত সাহসী হল কি করে সেটা ভাবতেই পারছে না মারুফ। যা সে কোনদিন ধারণা করেনি সেটা হচ্ছে। আজকের পুরো দিনটা খারাপ করেছে মিম আর রাতটা খারাপ করছে মিতু। 
শালার মেয়েগুলো এত ইমোশনাল। 
 
মারুফের চিন্তা ক্রমশ বাড়ছে। সম্মানহানী হবে সব জানাজানি হলে। মিতুর যা অবস্থা ওকে ফেরানো এখন যাবে না। বাচ্চাদের যদি ফিরে না পায় তাহলে তার থাকাটা বেশ কষ্টের। দুটো বাচ্চাকে সে পাগলের মত ভালবাসে। মিতু তাকে বাচ্চাদের থেকে সরিয়ে কষ্ট দিতে চায়। মারুফ ভাবতে পারে না।
ধুর যত্তসব পাগল ছাগল মেয়েদের সাথে এতদিন সে ছিল। সবাই তাকে মানসিক পাগল করে ছাড়বে দেখছি। ক্লান্ত দেহ বিছানায় এলিয়ে দেয়। রাজ্যের ঘুম থাকলেও এখন আর তার ঘুম আসে না।  


মিমকে উদ্ধার করে যতক্ষণ হাসপাতালে নেয়া হয় ততক্ষণে অবস্থার বেশ অবনতি হয়। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পাওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে গেছে সে। মাথায় আঘাত পাওয়ার পর একটা দীর্ঘ সময় অজ্ঞান থাকলে যা যা হয় তার সবকিছুর আশংকা করছেন ডাক্তার রা। খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে আসেন বাবা মা। এমনকি স্বামী মামুন ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে আসে।
ডাক্তাররা অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকায় অস্ত্রোপাচার করেন। ক্ষতস্থানগুলোতে ব্যান্ডেজ করেন। চব্বিশ ঘন্টা না গেলে কিছু বলা মুস্কিল। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত ডাক্তাররা কোন আশ্বাস দিতে পারছেন না।
সবাই যখন হাসপাতালের বারান্দার অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন তখন ডিউটি ডাক্তার জানান, হঠাৎ করে জ্ঞান ফিরেছে মিমের। ইশারায় সে কারো সাথে দেখা করার আবদার করছে বার বার। রোগীর কন্ডিশন বিবেচনায় ডাক্তার নিষেধ করলেও মিমের বার বার আবদারের ফলে মামুন কে দেখা করার অনুমতি দেন। 
 
সবাইকে অবাক করে দিয়ে চব্বিশ ঘন্টার অনেক আগেই চোখ মেলে তাকায় মিম। তার দু চোখ খুঁজছে দুজন মানুষকে। একজন তার ছেলে অন্যজন স্বামী।
জ্ঞান ফেরার পর হাসপাতালের আইসিউ বেডে মামুন তার ছেলেকে নিয়ে যায়। তাদের দেখে চোখ দিয়ে খানিকটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিছু বলার চেষ্টা করে মিম। মামুন থামিয়ে দেয়, এখন কিছু বলতে হবে না, আগে তুমি সুস্থ হয়ে নাও। অনেক কথা তখন বলো।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় মিম বলে, নাহ মামুন আমার সময় বোধহয় বেশি নেই। আমি যা পাপ করেছি, এটা অবধারিত শাস্তি। শেষ বেলায় এটুকু স্বান্তনা পাবো, তুমি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। শেষ বেলায় তোমার বউ হয়েই মরে যেতে চাই। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মিম। এতোটাই ভেঙ্গে পড়ে যে উপস্থিত বাবা ছেলের চোখেও জল আসে। 
 
প্লিজ এমন কথা থাক মিম। আগে সুস্থ হও। 
 
না তুমি বলো, আমাকে ক্ষমা করেছো। প্লিজ বলো প্লিজ। খুব কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে তবু বলছি। প্লিজ বলো। ছেলেকে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে।
তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসো। সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি মিম।
স্মিত হাসি দেয় মিম। যাক এবার মরতে ও শান্তি পাব। ছেলেটাকে শেষবার অনেক আদর করে। স্বামীর হাতটা ধরার আবদার করে মিম। হাত বাঁড়িয়ে দেয় মামুন। তোমার হাত ধরে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করতে চাই বলেই চোখ বুঝে নেয় মিম। মিমের শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত নীচে নামতে থাকে। গলার গোঙানী শোনা যায়।
মামুনের আওয়াজে ডাক্তার ছুটে আসেন। সব পরীক্ষা করেন ডাক্তাররা। ততক্ষণে মিম চলে যায় না ফেরার দেশে। 
 
ডাক্তারদের ধারণা কাকতলীয় ভাবে অল্প সময়ের জন্য সে জ্ঞান ফিরে পেয়েছিল।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মামুন আর তার ছেলে। বাইরে বাবা মা অঝোর ধারায় কাঁদেন। মামুন ভাবতে থাকে, এতকিছুর পেছনে নিশ্চয় তার অনেক ভুল ছিল, অবহেলা ছিল। ঠিকমত খেয়াল করেনি। নাহলে মিম এত ভুল করতে পারত না। 
 
আজ মিম মৃত্যু দিয়ে সব প্রশ্ন আরো উগরে দিলো।
হাসপাতালের কার্যকম শেষ করে বাসায় নিয়ে আসা হয় মিমকে। শেষ বিদায় দিতে গিয়ে ছেলেটা ভেঙ্গে পড়ছিল বার বার। মামুন তাকে বুকে জড়িয়ে রাখে। কোন কোন ভুলের মাশুল যে এভাবে দিতে হয় তা কে জানতো। 
 
মিমের মৃত্যুর খবর তার বিশ্বস্ত কারো মাধ্যমে মারুফের কাছে একসময় খবর পৌছে। কিন্তু তার চেহারায় খুব একটা চিন্তার রেখা দেখা যায় না। বিষণ্ণতার যত সব লক্ষণ তা সব বউ চলে যাবার কারণে। আলাদা করে মিমের জন্য তার মনের কোন অবস্থার পরিবর্তন হয় না। কেন যেন তার কাছে মনে হয় বরং উটকো ঝামেলা গেলো। সিংগাপুর যাওয়াটা আরো দুদিন পিছিয়ে রিসিডিউল করলো মারুফ । মিতু সেদিন রাতেই বাবার বাসায় চলে গেছে। এই দু তিনদিন অনেকবার চেষ্টা করে মিতুকে ফেরাতে পারেনি। ডিভোর্স অবধারিত জেনে বেশ চুপসে গেছে মারুফ। জীবন এত উলট পালট হবে ভাবতে পারিনি।
মারুফ ডির্ভোস লেটার পেলো এক সপ্তাহ পর মিতুর কাছে থেকে। ভাবতে পারছে না, মেয়েটা এত কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে। 
 
এখন আর তাকে ফেরানোর পথ নেই। মিতু পুরোটাই বদলে গেছে। এক বদলে যাওয়া মিতুকে সে আবিষ্কার করে এতদিন পর। সে জানে মিতু আর ফিরবে না। দীর্ঘ আয়োজন শেষে বেশ শান্ত মাথায় যারা বাসা ছেড়ে যায় তারা যাই হোক আর ফিরবে না সেটা সে জানে। তারপাশ জুড়ে একদিনের ব্যবধানে একাকিতে ভীড় করেছে। বেঁচে থাকাটা অর্থহীন মনে হচ্ছে। সব শুনে তার বাবা মা তিরস্কার করছে এখন। বরং মিতুকে সাপোর্ট দিচ্ছেন। চারপাশ থেকে আপন মানুষ খুব দ্রুত সরে যাচ্ছে। যা এতদিন সে কল্পনা করেনি। আইনজীবীর সাথে পরামর্শের জন্য বাসা থেকে বের হয় মারুফ। যেভাবে হোক বাচ্চাদের ফেরত পাওয়ার আইনি লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে। 
 
বাইরের আকাশটা আজ অন্যরকম। মারুফের মনের মত উলট পালট হচ্ছে। এক জীবনে এত সত্যের মুখোমুখি হওয়া লাগবে, গতকাল ও তার কল্পনায় ছিল না। কত সহজেই বদলে গেলো সব। ঘর দুয়ার ওদের ছাড়া সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মানসিক যন্ত্রণা তাকে পেয়ে বসছে। এতদিন এসব কিছুই টের পায়নি। কিন্তু এখন দিন দিন অস্থিতিশীলতা তাকে পেয়ে বসছে। জানি না সে কী করবে এখন। নিজের গাড়ী নিয়ে ছুটে চলে আইনজীবী তার বন্ধু রহমানের চেম্বারের দিকে।
()
ঠিক এক সপ্তাহ পর হঠাৎ করে পুলিশ আসে মামুনের বাসায়। মামুন তখন বিকেলে বারান্দার তার এক বন্ধু শায়লার সাথে গল্প করছিলো মুলত মিমকে নিয়ে। অনেকটা স্মৃতিচারণ মুলক কথা। শায়লা গত মাসে দীর্ঘদিন পর ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছে । বন্ধুর এ অবস্থা শুনে দ্রুত আসে মামুনের সাথে দেখা করতে।
হঠাৎ পুলিশকে দেখে বেশ অবাক হয় তারা দুজনেই। ওসি শহিদুল এর নেতৃত্বে তিনজন পুলিশ সদস্য এসেছেন। তাদের বসতে দিয়ে মামুন জিজ্ঞেস করে , ওসি সাহেব আপনি হঠাৎ কী মনে করে ?
সরি অসময়ে আপনাকে বেশ ডিস্টার্ব করার জন্য, ওসি শহিদুল আড় চোখে শায়লাকে দেখে দেখে বলেন। 
 
না না ঠিক আছে বলুন।
ইনি কে হোন আপনার মিঃ মামুন। শায়লাকে ইশারা করে বলেন ওসি।
ও আমার ছোট বেলার বন্ধু শায়লা। দীর্ঘদিন পর দেশে এসেছে। তাই দেখা করতে এসেছে।
ওহ আচ্ছা। হাই মিস শায়লা ? কেমন আছেন ?
জ্বি বেশ ভালো। আপনি ?
আমি আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভাল আছি। আমি কি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি মিস শায়লা ?
জ্বি অবশ্যই করুন, কিছুটা ঘাবড়ে যায় শায়লা। এমন পরিস্থিতিতে সে বাংলাদেশে কখনো পড়েনি।
আপনার স্বামী কোথায় আছেন ? প্রশ্নটা একান্ত ব্যক্তিগত তবু করে ফেললাম।
জ্বি ও ইংল্যান্ডে থাকে। আমাদের চার মাস আগে ডির্ভোস হয়ে গেছে।
ওহ সরি। থ্যানক ইউ মিস শায়লা। মামুন সাহেব আপনাকে কিছু বিষয় জানাতে আসলাম।
জ্বি বলুন ওসি সাহেব।
নিহতের বাবার পরিবার থেকে ধারণা করা হচ্ছে এটা একটা হত্যা। কেউ এক্সিডেন্টের নাম করে হত্যা করেছে। আপনার কি এমন ধারণা হয় ?
 
-কার ধারণা এমন ওসি সাহেব। 
 
গতকাল নিহত মিমের আপন ভাই সুমন অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরত এসেছেন । উনি এক্সিডেন্টের জায়গা স্থানীয় কিছু মানুষের সাথে কথা বলেছেন। তখন অনেকে উনাকে জানিয়েছে যে, যে ট্রাকে উনার এক্সিডেন্ট হয়েছে, সেটা নাকি একটু অদূরে দীর্ঘক্ষণ থেকে অপেক্ষামান ছিল। উনি রোডে আসার সময় তীব্র গতিতে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। আমরা অবশ্য ট্রাক সনাক্ত করেছি। ড্রাইভার পলাতক।
ওহ মাই গড। সুমন আমাকে তো কিছুই জানায়নি।
আমরাই তাকে জানাতে নিষেধ করেছিলাম। আপনার স্ত্রীর সাথে এক্সিডেন্টের আগের দিন রাতে সুমন সাহেবের সাথে ফোনে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়েছে । তখন উনি নাকি বিপদের আশংকার কথা ভাইকে জানিয়েছিলেন। 
 
আমি তো কিছুই জানি না।
আস্তে আস্তে সব জানবেন মামুন সাহেব। যেহেতু মামলা হয়েছে। কিছু সত্য মিথ্যা প্রকাশ তো পাবে।
মানে কী ? সুমন মামলা করেছে।
জ্বি মামলা হয়েছে। তবে কাউকে আসামী করা হয়নি। আমরা আশে পাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখছি। তদন্তের স্বার্থে খুব বেশি কিছু জানাতে পারব না। তবে কিছুটা আলামত পেয়েছি। আপনাকে আমাদেরকে কোঅপারেটিভ করতে হবে মামুন সাহেব।
জ্বি অবশ্যই। 
 
আপনার সাথে দাম্পত্যকলহ ছিল উনার। আপনি তাকে মৃত্যুর কিছুদিন আগে বাবার বাসায় রেখে এসেছিলেন। কেন রেখে এসেছিলেন তাও আমরা জেনেছি। আপনি অবশ্য আপনার জায়গা থেকে একশ পারসেন্ট রাইট ছিলেন। আমরা এও জেনেছি যে,বিশিষ্ট শিল্পপতি মারুফ সাহেবের সাথে উনার ফিজিক্যাল সম্পর্ক ছিলো। এক্সিডেন্টের অদূরে একটা ফ্ল্যাটে মিমের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। যেটা মারুফ সাহেব রেন্ট নিয়েছিলেন। আর সে বাসাটা আপনার বন্ধু রকিবের।
জ্বি যা শুনেছেন সব সত্য। 
 
ইতিমধ্যে আমরা ছয় থেকে সাতটা মোবাইলের কল লিস্ট চেক করছি। বেশ কিছু অসামাঞ্জস্যতা মিলেছে। আপাতত কিছু বলছি না। তদন্তের স্বার্থে আপনারা অনেকেই আমাদের সন্দেহের তালিকায়।
কি বলছেন এসব। আপনারা কি আমাকে সন্দেহ করছেন। 
 
জ্বি করছি। যদিও আপনার শ্বশুরবাড়ী থেকে আপনার অনেক প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা তদন্তের স্বার্থে কাউকে ছাড় দিতে রাজি না। আপাতত আপনি শহর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আমরা কেউ সিউর না এটা হত্যা। মামলা হয়েছে তাই দেখতে হচ্ছে। হয়ত প্রয়োজনে কবর থেকে লাশ তুলতে হতে পারে তবে সেটা আমাদের প্রাথমিক তদন্তের পর যদি কিছু প্রমাণ পাই। আদালতের অনুমতি নিয়েই বাদ বাকী কাজ করব। মিমকে চিকিৎসা দেয়া কর্তব্যরত ডাক্তারদের সাথে আমরা আলাপ করব এই নিয়ে। 
 
আপনারা আপনাদের কাজ করুন। আমিও চাই যদি হত্যা হয়, তবে আমরা যেন ন্যায় বিচার পাই।
আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন ?
জ্বি না।
একদম না মামুন সাহেব ?
সন্দেহ করলে একজনকেই করা যায়। একমাত্র লোক ঐ যে মারুফ সাহেব। যে আমার সংসার তছনছ করে দিয়েছে ওসি সাহেব। 
 
উনি গতকাল রাতে মামলা হওয়ার এক ঘন্টা পর সিংগাপুর চলে গেছেন।
তাহলে আর কি প্রমাণ লাগে ? কিছু যদি হয়েও থাকে তবে উনিই করেছেন।
মামুন সাহেব আপনি কি করে সিউর হলেন ..উনি করেছেন ।
না, আপনি বললেন উনি পালিয়েছেন তাই বললাম।
আমি পালানোর কথা বলিনি। জেনেছি উনি ব্যবসার কাজে গেছেন।
ঐ একই কথা ওসি সাহেব। 
 
আচ্ছা রাকিব সাহেব যে আপনার স্ত্রীকে উত্যক্ত করতেন, ফিজিক্যাল এটাচের জন্য চাপ দিতেন। এমনকি কথা না শুনলে উনি মারুফ সাহেবের কথা আপনাকে জানিয়ে দেবেন বলে হুমকি দিতেন। এসব কি জানতেন আপনি মামুন সাহেব। এ নিয়ে মারুফ সাহেব আর রাকিব সাহেব দুজন বেশ বচসা করেছেন। সে খবর আমরা পেয়েছি। রাকিব সাহেবের গতিবিধি সব সময় সন্দেহজনক ছিল। এমনকি আপনার বাসার আগের কাজের ছেলে মিল্টন আমাদের সন্দেহ তালিকায়। যাকে তিন মাস আগে চাকরিচ্যুত করেছিলেন তুচ্ছ কারণে আপনার স্ত্রী।
 
কী বলেন এসব। আমি এসবের কিছুই জানি না। তবে হ্যা রাকিবের কাছে থেকে তার ফ্ল্যাটে যাতায়াতের কথা শুনেছি। তার মাধ্যমে শুনেছি মারুফের সাথে মিমের সম্পর্কের কথা। মিল্টন প্রায় সময় চুরি করত বলে জেনেছি মিমের কাছে থেকে। সেজন্য সে চাকরীচ্যুত করেছিল।
অথচ ঘটনা ভিন্ন ছিল মামুন সাহেব। আপনি হয়ত সেসব জানেন না। অন্য কিছু লুকাতে মিল্টনকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। আপাতত আমরা আপনাকে তা বলছি না। আর রাকিব অনেক জ্বালিয়েও পাত্তা না পেয়ে আপনাকে জানিয়েছে। মিম তার কথায় রাজি হয়নি। আপনি নাকি সেই বাসার কেয়ারটেকার কে টাকা দিয়েছিলেন মিমের আসা যাওয়ার খবর জানাতে।
হ্যা দিয়েছিলাম। একজন স্ত্রীর খবর নিতে এটুকু দেয়া কি পাপ ?
না না উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আমি পাপের কথা বলিনি। জাস্ট জানতে চাওয়া। আমরা সুমন সাহেবের মাধ্যমে আপনার স্ত্রীর মোবাইল জব্দ তালিকায় নিয়েছি। যাচাই বাছাই করছি।
আচ্ছা আমি যাই আজ। অন্যদিন প্রয়োজন হলে আসব অথবা আপনাকে ডেকে পাঠাবো। আশা করছি আপনার সহযোগীতা পাব।
জ্বি নিশ্চয়। 
 
আচ্ছা আসি মামুন সাহেব। মিস শায়লা দেখা হবে নিশ্চয়। শায়লা মাথা নাড়ায়।
ওসি শহিদুল এক কদম সামনে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলেন, মিস শায়লা আপাতত আপনিও এই শহর ছেড়ে যাবেন না প্লিজ। 
 
শায়লার মেজাজ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়, আপনার কি মাথা খারাপ ওসি সাহেব। যা তা বলছেন।
জ্বি সব ওসির এসব কেসে মাথা খারাপ থাকে। আশেপাশে যাকে দেখে তাকেই সন্দেহ করে। আপনিও আমাদের সন্দেহের তালিকায়। ওসি শহিদুল দ্রুত বেগে চলে যান বাসার বারান্দা থেকে।
ঝিম মেরে বসে থাকে মামুন। ভাবতেই পারছে না কি হচ্ছে এসব। সুমনের সাথে কথা বলা দরকার। সুমন তো তাকে বলতে পারত। 
 
শায়লা বেশ ঘাবড়ে গেছে যদিও। এসব কি মামুন ?
আমি এসে কি একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম।
আরে এত ভেব না। যা সত্যি তা পরিষ্কার। এসব নিয়ে মাথা ব্যথা বাড়িও না। দেখা যাক কি হয় ?
আচ্ছা আমি যাই রে। পরে কথা হবে। 
 
শায়লা চলে যায়। মামুন তখনো বারান্দার বসে থাকে। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে প্রায় রাত নেমে এসেছে। আজ শুক্লা পঞ্চমীর চাঁদ উঠেছে মেঘমুক্ত আকাশের পিঠে। ওদিকে তাকিয়ে বেনসন হেজেসের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট ধরায়। ধোঁয়া ছাড়ে আর ভাবনার জগতে হারিয়ে যায়, যেখানে তার আশেপাশে জুড়ে ছিল কেবল মিম। সেই মিম হারিয়ে গেছে বেঁচে থাকতেই। 
 
আজ কেন জানি সবকিছু ধোঁয়াশা লাগছে। আসলে কি মিমকে হত্যা করা হয়েছে। আপাতত এই প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে নেই। 
 
তবে আজ মামুন নিজেই স্ত্রী হত্যার সন্দেহভাজন। মারুফের কাছে সবকিছু কেমন রহস্য রহস্য লাগছে। মানুষের জীবন গল্পগুলো কী এমন রহস্যময় হয়। একটা রহস্যের আঁচ লাগিয়ে কী কারো কারো জীবনের যবনিকাপাত হয়। তাও আরেক রহস্য। আসলে প্রত্যেকটা মৃত্যু এক একটা রহস্য। এই রহস্য সবাই ভেদ করতে পারে না। 
 
পরকীয়া প্রেম এর পরিনতি কখনই ভালো হয়না।
ইসলামিক নীতিবোধ মনে থাকলে শত কষ্টেও কেউ বিপথে যায়না।মানুষ যখন আল্লাহ্‌ কে ভয় করেনা নফসের অধিন হয়ে যায়। বিভিন্ন পাপে নিমজ্জিত হয়।পরকীয়া প্রেম বর্তমান জমানার কঠিনতম সমস্যা। যার সমাধান আইন করেও সম্ভব নয়।দিন দিন এই সমস্যা বেড়েই চলেছে।যত খুন হয় তার বেশিরভাগ কারণ হয় পরকীয়া নয় রাজনৈতিক।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url