শ্মাশানঘাট | Crematorium (Secret Star)
শ্মাশানঘাট
সিক্রেট স্টার
সজল ব্যাটা একেবারে মহা হারকিপটে । কখনও ভুলেও ওর কাছ থেকে একটা টাকা খসানো যায় না । এমন নয় যে ওরা গরীব। টাকা পয়সা নেই । টাকা শহরে ও’র বাবার চার-চারটে বাড়ি । এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো নানা রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য । ভাইগুলো সব বিদেশে লেখাপড়া করছে । দু’দিক থেকে টাকা পয়সা ওদের বাসায় ঢুকছে কিন্তু বেরুবার পথ পাচ্ছে না । তবুও ব্যাটার এমন কিপটেমি আমাদের আর সহ্য হয় না । দিনের পর দিন আমাদের টাকায় এটা সেটা খেয়ে দেয়ে বেশ আছে । তাই আমরা একদিন ঠিক করলাম যে, ওকে একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো । তাতে যাদি ওর হাড় কিপটেমি ভাবটা দূর হয়। রতনদের বাড়ী বুড়িগঙ্গা নদীর খুব কাছে । আমাদের স্কুল থেকে ওদের বাসাটা কাছে হওয়ায় স্কুল ছুটির পর কিংবা বন্ধের দিনগুলোতে আমাদের বেশির ভাগ আড্ডাগুলেই রতনদের দোতালার ছাদেই হতো । রতনদের ছাদ থেকে বড়ীগঙ্গা নদীর পুরোটা দেখা যায় । বিকেল বেলা নদীর বুকে ব্যস্ত লঞ্চগুলো দেখতে বেশ লাগে । তাই আড্ডার জন্য এর চেয়ে আর্দশের জায়গা আর হয় না । যে কোন ভাল জিনিষের পাশাপাশি যেমন একটা খারাপ জিনিষ থাকে । ঠিক তেমনি রতনদের ছাদ থেকে বুড়ীগঙ্গার সন্ধ্যাকালীন মনোরম দৃশ্য দেখার পাশাপাশি আরেকটি খারাপ জিনিসও খুব ভাল করে দেখা যায় । সেটি হলো – পোস্তগোলা শ্মশানঘাট । এটি মনে হয় ঢাকা শহরের একমাত্র শ্মশানঘাট । তাই মরদেহ পোড়ানোর ধুম লেগেই থাকে । কারো জন্য সেটি শেষ যাত্রা হলেও আমাদের জন্য শ্মশানঘাটটি অতি ভয়ন্কর একটা জায়গা। কেননা এই শ্মশানঘাটটি নিয়ে নানান ভৌতিক ঘটনা প্রচলিত আছে । যেগুলোর বেশির ভাগই খুব ভয়ন্কর । শুনলেই গা শিনশিন করে উঠে । শ্মশানঘাটে নাকি রাতের অন্ধকারে প্রায়ই – তেনাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় । বিশেষ করে অমাবশ্যার রাতে । তখন যদি কেউ তেনাদের সামনে পরে তাহলে আর রক্ষা নাই । নির্ঘাত পরের দিন হয় মৃতদেহ পাওয়া যাবে নয়তো পাগল অবস্হায় পাওয়া । তাই আমরা পারতে খুব একটা ওদিকটা মারাই না । এড়িয়ে চলি । রতনদের ছাদ থেকে প্রায়ই দেখা যায় শ্মশানঘাটে কুন্ডুলি পাকিয়ে মরদেহ পোড়ানোর ধোয়া আকাশে উঠে যাচ্ছে । বাতাস আমাদের দিকে বইতে থাকলে চামরা পোড়ার একটু গন্ধও পাওয়া যায় বলে আমার মনে হয় । যদিও গন্ধ পাওয়ার ব্যাপারটা কেউই স্বীকার করে না । তবুও আমার মনে হয়েছে আমি বার দু’য়েক পোড়া চামরার গন্ধ পেয়েছি । একদিন সাহস করে আমরা ক’জন মিলে গিয়েছিলাম শ্মশানঘাটে লাশ পোড়ানো দেখতে। কিন্তু সে দৃর্শ্যটা আমি সহ্য করতে পারিনি ভয় পেয়ে চলে এসেছি । দু-তিন জন লোক বিরাট বিরাট লাঠি দিয়ে নেড়ে চেড়ে মরা পোড়াচ্ছে । দেখলেই গা ঘুলিয়ে উঠে। আমাদের মধ্যে ফিরোজই সব চাইতে সাহসি । ফিরোজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো লাশ পোড়ানো দেখেছে । লাশ পোড়ানো শেষে ছাইগুলো যে একটি ছোট কলসিতে ভরে নদীতে ফেলে দেওয়া হয় ও সেটাও দেখে এসেছে । সেই ফিরোজকে একদিন ছাদে দাঁড়িয়ে শ্মশানঘাটটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়তে দেখলাম । আমরা তখন কেরাম খেলছিলাম । আমরা বলতে- আমি , বাপ্পি ,তপন আর সজল । রতন গিয়েছিল নীচে আমাদের জন্য ঠান্ডা পানি আনতে । ফিরোজ একটু দেরি করে আসায় খেলায় অংশ গ্রহন না করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কখনও নদী আবার কখনও শ্মশানঘাটটি দেখছিল । ওকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে দেখে আমি আর বাপ্পি এগিয়ে গিয়ে ওর কাধে হাত রেখে – জিজ্ঞেস করলাম কিরে কি হয়েছে?
– না কিছু না । ফিরোজ মাথা নেড়ে কিছু না বলে আমাদের এড়িয়ে যেতে চাইল ।
– কিছু না বললেই হলো ! আমি স্পস্ঠ তোকে বোয়াল মাছের মতো বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে দেখলাম ।
– বললাম তো কিছু না । এমনি ….
– দেখ মিথ্যা বলবি না । আমরা না তোর বন্ধু । বাপ্পি ফিরোজ এর কাধে হাত রেখে বলল ।
– না, মানে শ্মশানঘটটা দেখে ভাবছিলাম -মানুষ মরে গেলেই তো সব শেষ তাই না ? ফিরোজ আবারও উদাস হয়ে বলল ।
– তা তো ঠিকই মরে গেলেই তো সব শেষ । বলে আমিও ওর সঙ্গে মাথা নাড়ালাম ।
– মরে গেলে সব শেষ হবে কেন ? মরে গেলে তো মানুষ ভূত হয়েওতো টিকে থাকার চেষ্টা করে । তপন এর কথায় আমরা সবাই হেসে উঠলাম ।
– শুন ব্যাটা ভূত বলে আসলে কিছু নাই । সব মনের ভূল । সজন বীরের মতো বলল ।
– তুই জানস না , আমাদের ঠাকুর মারা বলেন – যারা বেঁচে থাকতে অন্যায় জুলুম করে তারা মরে গেলে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায় ।
– তোর দাদি মার কি ভাবে জানলো এ কথা ? তারা কি ভূত প্রেত দেখেছে ? সজল তপনকে একেবারে তুচ্ছ তাচ্ছিল করে প্রশ্ন করল ।
– দেখেছেই তো । তপন আমতা আমতা করে উত্তর দিল ।
– যতোসব বাকোয়াস কথা ।
– বাকোয়াস না , দিদা বলছে দাহের পর তিন চার ঘন্টা পর্যন্ত নাকি তেনাদের আত্মা শ্মাশানঘটে ঘুরে বেড়ায় । তখন নাকি তেনাদের দেখাও যায় ।
– তোর দিদা চাপা মেরেছেরে । পুরো আজেন্টিনা চাপা মেরেছে। বলে সজল হো হো করে হাসতে লাগল ।
– তোর খুব সাহস মনে হচ্ছে যে । ফিরোজ সজলকে উদ্দেশ্য করে বলল ।
– সাহসই তো , তোর মতো নাকি যে, দিনের বেলায় শ্মাশানঘাটে ঘুরে এসে বাহাবা ফলাবো । আমি চাইলে রাতেও শ্মাশানঘাট ঘুরে আসতে পারি ।
– তাই নাকি ! তাহলে প্রমাণ দিয়ে দে ? দেখবো কতো বড় বুকের পাটা । ফিরোজ তেতে উঠে বলল।
– প্রমাণ লাগবে কেন , যা সত্য তাই বললাম ।
– কি ভাবে বুঝবো যে তুই রাতের বেলা শ্মাশানঘাট থেকে ঘুরে আসতে পারবি ? আমি বললাম ।
– আমি ইচ্ছে করলে প্রমাণও দিতে পারি কিন্তু দিমু না । কিন্তু দিমু না , প্রমান দিয়ে আমার লাভ কি । আমি বুঝলাম সজল ধান্ধা খুঁজছে ।
– যদি তুই রাতের বেলা শ্মাশানঘাট থেকে ঘুরে আসতে পারিস তা হলে তুই যা খেতে চাবি তাই তোকে খাওয়াবো । ফিরোজ বলে আমাদের সবার দিকে তাকালো।
– হু যা তাই খাওয়াবো । বলে আমরা সবাই মাথা নাড়লাম ।
– আবে রাখ তোদের খাওয়া দাওয়া । নগদ মাল কতো দিবি তা ক ?
– যা , সবাই মিলে তোকে একশ টাকা দিমু ।
– দিবি তো ? সজল এর চোখ দু’টো চকচক করে উঠতে দেখলাম ।
– অবশ্যই দেবে । তবে আমাদের কথাও তোকে শুনতে হবে । ফিরোজ বলল ।
– কি কথা ?
– তুই শ্মাশানে রাত ১২টা পরে যাবি । বলে ফিরোজ আমাদের দিকে চেয়ে একটু হাসল । আমি মনে মনে ভাবলাম রাত ১২টা কথাশুনে সজল হয়তো পিছিয়ে যাবে । কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ও বলে উঠলো – রাত ১২টা কেন ? মাল পেলে রাত ১টা’র পরে যেতেও রাজি আছি ।
– তাহলে আজ রাতেই যা । ফিরোজ বলল ।
– ওকে নো প্রবলেম । আগে মাল দে । আমি বাকির কাজ করিনা । জানস তো বাকি কাজ ফাঁকি । আমরা আমাদের সবার পকেটে যা ছিল তা মিলমিশ করে একশটাকা জোগার করে সজল এর হাতে তুলে দিলাম । তপন শুধু বলল ও আসতে পারবে না । এতো রাতে নাকি ও কিছুতেই বাসা থেকে বেড় হতে পারবেনা । সবাই মিলে ঠিক করা হলো যে, রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে আমরা যার যার মতো রতন এর বাসার নীচে চলে আসবো । তারপর ১২টা বাজলে সজল চলে যাবে শ্মাশানে আর আমরা শ্মাশানের কাছে কর্টন মেলের গেটে অপেক্ষা করবো ।
দুই
স্কুল বন্ধ থাকলেও এতো রাতে বাসা থেকে বেড় হওয়াটা আমার জন্য খুব একটা সহজ হলো না । শেষমেস ছোট মামাকে সব খুলে বলার পর মামা নিজেই আমাকে নিয়ে বেড় হলেন । রতনদের বাসায় নীচে আসার পর দেখলাম রতন, ফিরোজ, বাপ্পি অপেক্ষা করছে । সজল কোথায় জিজ্ঞেস করাতে ফিরোজ বলল – ও শালায় এখনও আসেনি ।
– মনে হয় ভেগেছে । রতন ফিরোজ এর কাধে হাত রেখে বলল।
– টাকা নিয়েছে না, ভেগে যাবে কোথায় ? ডাবোল আদায় করে ছাড়বো । আমাদের সঙ্গে মামদো বাজি চলবে না । ফিরোজ উত্তেজিত হয়ে বলল । আমি হাতঘড়ি দেখলাম রাত পৌনে ১২টা বাজে । একটু যেন শীতও পড়ছে । তবে আকাশ বেশ পরিস্কার । সাদাসাদা মেঘ মাথার উপড় দিয়ে উড়ে চাচ্ছে। আকাশে বিশাল রুপালী একটা চাঁদ । আমি মুগ্ধ হয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম । বাপ্পি কোন কিছু না বললেও ঘুনঘুন করে গান গাইছে । ছোট মামাকে দেখলাম একটু দূরে সড়ে গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। আমরা যখন সজল আসবে না ভেবে ফিরে যাবার বলো ঠিক করে ফেলেছিলাম । ঠিক সে সময় সজল আসল । ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় ১২টা বাজে । সজল এসেই আমাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল- চল, যাওয়া যাক । সজলকে দেখে আমার কিছুটা অন্যমনন্স্ক আর কেমন যানি চুপচাপ মনে হলো । আমি ভাবলাম হয়তো সাহস দেখাতে গিয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফান্দে পরে গেছে সেই জন্য মন খারাপ । আমি ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললাম – কিরে সজল ! ভয় লাগছে ? যাওয়া বাদ দিবি?
– না , চল, যাওয়া যাক । সজল বেশ গম্ভীর ভাবে বলল ।
– তোর খারাপ লাগলে, থাক না ।
– আহা : বিরক্ত করিস না, বললাম তো চল ।
– কি হইছে রে ? ফিরোজ আমার পাশে এসে জিজ্ঞেস করল ।
– না , কিছু না । আমি জিজ্ঞেস করছিলাম ওর খারাপ লাগছে কিনা ।
– কিরে সজলা বাদ দিবিনি যাওয়া ? ফিরোজ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল । ফিরোজ এর বলার মধ্যে কেমন একটা খোঁচার আভাস পেলাম । সজল কিছু না বলে হাঁটতে লাগল ।
হঠাৎই সবাই কেমন যানি চুপচাপ হয়ে গেছি । সবাই নীরবে হাঁটছি । বেশ কিছুক্ষন হাঁটার পরে আমরা কর্টন মেলের পেছনের গেটে এসে দাঁড়ালাম । কর্টন মেলের পেছনটা বেশ নীরব । সামনের দিকের মেইন রাস্তায় দু’চারজন লোকজন থাকলেও এদিকটা একেবারে জনশূন্য । আমরা দাঁড়িয়ে পরলেও সজল কিন্তু দাঁড়ালো না । ও সোজা শ্মাশান ঘাট এর দিকে হাঁটতে থাকলো । আমি প্রায় দৈড়ে গিয়ে বললাম – সজল দাঁড়া , ভাল করে ভেবে দেখ যাবি কি না !
– ভাবাভাবির কিছু নাই । তোরা এখানে থাক আমি শ্মাশান ঘাট থেকে ঘুরে আসছি ।
– আমরা বুঝবো কি করে যে, তুই আসলেই শ্মাশান ঘাটের ভেতরে গেছিস । বাপ্পি এসে প্রশ্ন করল ।
– আমি প্রমাণ নিয়ে আসবো ;
– কি প্রমাণ আনবি শুনি ।
– মরা পোড়ানোর লাকড়ী নিয়ে আসলে চলবে ? কথাটা বলে সজল খেক খেক করে হাসতে হাসতে এগিয়ে গেল । এ সজলকে আমার কেমন যানি খুব অপরিচিত মনে হলো । মনে হলো – ওকে যেন আমি ঠিক চিনিনা । এই প্রথম দেখলাম । ওর হাসির শব্দে আমার পুরো শরীর কাটা দিয়ে উঠল । আমি কোন কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম । আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সজল এক সময় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল । আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি চাঁদটা ততোক্ষনে মেঘের আড়ালে চলে গেছে । আমার কেন যেন খুব ভয় ভয় করতে লাগল । সবাই কেমন চুপচাপ হয়ে আছি । কারো মুখেই কোন কথা নেই । ছোট বেলা থেকে পড়ে এসেছি – সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা । কিন্তু এখানে আসার পর দেখলাম সময় কি করে স্লো হয়ে যায় । ঘড়ির কাটা যেন আর চলতেই চাচ্ছে । সময় যেন আটকে আছে মহাকালের আর্বতে।
একটু একুটু করে আধ ঘন্টা পেরিয়ে যাবার পর সজলকে ফিরতে না দেখে আমরা সবাই অস্থির হয়ে উঠলাম । মনে মনে এই ভেবে ভয় পাচ্ছি সজল এর কোন বিপদ হলে ওর বাবা মাকে আমরা কি বলব ? সবাই কি ভাববে আমাদের । আমার বাবা তো আমাকে পিটিয়েই মেরে ফেলবে । ভয় মানুষের কল্জে শুকিয়ে যায় শুনেছি কিন্তু আমার বেলায় দেখলাম ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে । মনে হলো একটু পানি খেতে পারলে ভাল হতো । আমরা সবাই অস্থির হয়ে পায়চারি করছি । ছোটমামা একটা গাছের গুড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছেন । ফিরোজ একটু পর পর চুক চুক শব্দ করে বিরক্তি প্রকাশ করছে । আরো আধ ঘন্টা যাবার পরে আমি বললাম – চল আমরা এগিয়ে দেখি ও এখনও আসছে না কেন ? মামা বললেন – তাই চল, আমার মনে হয় ওর কোন বিপদ হয়েছে । ফিরোজ কিছু বলতে যাচ্ছিল – বাপ্পি বলে উঠল ,তোরা যা, আমি বাবা মরে গেলেও শ্মাশানে যাবো না । মরতে হয় এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে মরে যাবো, তবু বাবা শ্মাশানে যাবো না । অগত্য আমরা রতন আর বাপ্পিকে রেখে রওনা দিলাম । যাবার সময় ওদের বলে গেলাম, আমরা যদি আধা ঘন্টার মধ্যে না ফিরি তাহলে ওরা যেন যা ভাল মনে করে তাই করে । ওরা একজন অন্যজনের গায়ে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থেকে মাথা নাড়ল । শীতটা যেন হঠাতই বেড়ে গেছে । আমরা একজন অন্যজনের গা ঘেষে চাঁদের আলোয় হাঁটছি । কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই যেন বোবা হয়ে গেছি । বেশ কিছুক্ষন হাঁটার পর ফিরোজ হাত দিয়ে সামনের দিকটা দেখিয়ে বলল- ঐ যে দেখ, কে যেন হেঁটে যাচ্ছে । ওর হঠাৎ কথা বলে উঠায় আমি বেশ চমকে গেলেও সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম , সত্যিই কে যেন খুব ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে শ্মাশানের দিকে যাচ্ছে । আমার সাহস বেড়ে গেল – আমি বললাম সজল না তো ? মামা বললেন – মনে হয় না, এক ঘন্টা আগে রওনা দিয়ে ও এতোক্ষন নিশ্চয়ই এখানে দাঁড়িয়ে থাকেনি !
– তাহলে হয়তো নাইট গার্ডটাড কেউ হবে, তারাতারি পা চালা কাছে গিয়েই দেখি না কে ? বলেই ফিরোজ জোড়ে হাঁটতে লাগল । আমি আর মামাও জোড়ে পা চালালাম । হাঁটতে হাঁটতে নদীর পার দিয়ে আমরা অনেকটা দূরে চলে এসেছি । আমাদের সামনে হাঁটতে থাকা আবয়াবটাকে এবার বেশ স্পস্টই দেখা যাচ্ছে । চাঁদের আলোয় চাদরে শরীর ঢেকে হেলে দূলে লোকটা এগিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ্য করে আমারা অবাক না হয়ে পারলাম না । আমরা জোড়ে জোড়ে পা চালিয়েও লোকটার কাছাকাছি হতে পারছি না । আমার কাছে মনে হলো লোকটাও যেন আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একসময় ফিরোজ জোড়ে হাক দিয়ে বলল- এই যে শুনছেন ? একটু দাঁড়ান না ,আমরাও ওদিকে যাবো । লোকটা আমাদের দিকে না তাকিয়েই মেয়েলি গলায় মিনমিন করে বলল- এগিয়ে আসো । কিন্তু, আমরা আরো জোড়ে পা চালিয়েও লোকটার কাছাকাছি হতে পারলাম না । এভাবে আরো কিছুক্ষন হাঁটার পর হঠাৎ মামা বললেন – দাঁড়াও তোমরা, আমারা মনে হয় আমরা খারাপ জিনিষের পাল্লায় পরেছি । আমি আর ফিরোজ সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলাম । সমগ্র শরীর দিয়ে ঘাম টপটপ করে পরছে । ফিরোজ প্রশ্ন করল – খারাপ জিনিষ মানে কি মামা ?
– খারাপ জিনিস মানে হচ্ছে খারাপ জিনিষ । দেখছো না আমরা কতো চেষ্টা করেও ওটার কাছাকাছি হতে পারছি না । মামার কথা শুনে আমার সারা শরীর ঝিম ঝিম করে উঠল । ফিরোজ কিছু বলল না । চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল । মামা বললেন – দাঁড়িয়ে থেক না হাঁটতে থাকো ওটা যদি বুঝতে পারে যে আমরা ভয় পেয়েছি তাহলে খবর আছে । আমরা ধীর পায়ে আবারও হাঁটতে লাগলাম । একসময় ফিরোজ ফিসফিস করে বলল- মামা চলেন ফিরে যাই । ফিরোজ যেন আমারই মনের কথাটা বলল । মামা বললেন- আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি এখন সামনে যাওয়া যা,পেছনে যাওয়া তার চাইতেও ভয়ন্কর । দোয়া দুরুত পড়ে বুকে ফু দিয়ে হাঁটতে থাকো । আমি মনে মনে দোয়া দুরুত পড়তে চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না । কিছুই মনে পড়ল না । বিরবির করে উল্টা পাল্টা কি সব পড়লাম । একটা মোড় ঘুরে শ্মাশান ঘাটের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ করে চাঁদটা মেঘের আড়ালে চলে যাওয়ায় চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল । আমি আর ফিরোজ ভয় পেয়ে মামার জামা টেনে ধরলাম । মামা বিরবির করে বললেন – ভয় পাবি না ,ভয় পাবি না । একদম না । একদম না । মামা ভয় পেতে না করলেও আমি কিন্তু ঠকঠক করে কাঁপছি । আর মামাকে ধরে একটু একটু করে এগুচ্ছি । শ্মাশান ঘাটের গেটে আসার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদটাঁ আবার মেঘের আড়াল হতে বেড় হয়ে এলো । মনে মনে আলাহকে ধন্যবাদ দিলাম । ততোক্ষনে আমাদের সামনে হাটতে থাকা লোকটা কোথায় যেন উদাও হয়ে গেছে । লোকটাকে কোথাও আর দেখলাম না । আমরা গেট দিয়ে শ্মাশানের ভেতরে ঢুকলাম । পুরো শ্মাশানে শুনশান নীরবতা । ঝিঝিপোকাও ডাকছে না । আমরা সজলকে খুঁজতে লাগলাম । কিন্তু কোথাও ওকে দেখা গেল না । গেটের কাছে দাঁড়িয়েই ফিরোজ – এই সজল, বলে বার দুয়েক ডাক দিলো । কিন্তু কেউ উত্তর দিলো না । রাতের অন্ধকারে সে ডাক প্রতিধ্বর্ণিত হয়ে ফিরে এলো।
মামা বললেন – চলো ভেতরে দিকে যাওয়া যাক , হয়তো ও ভেতরে আছে । মামা আমাদের জন্য আর অপেক্ষা না করে পা বাড়ালেন । আমরাও দুরুদুরু বুকে মামার পেছন পেছন যেতে লাগলাম । কিছুটা ভেতরে ঢুকে বামপাশে ঘুরতেই কিছুটা দূরে চারকোনায় চারটা কালো লোহার মোটা রর্ড পোতা উচু একটা পাঁকা জায়গা দেখে বুঝলাম – এখানেই লাশ পোড়ানো হয় । তার কিছুটা দূরেই ডান পাশ দিয়ে নদীটা দেখা যাচ্ছে । আমি ডাক দিলাম – সজল ! এ্যই সজল , তুই কোথায় ? নিজের গলা নিজের কাছেই কেমন অপরিচিত মনে হলো । – সজল এখানে নেই , মামা কথাটা বলে নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন । আমরাও পেছন পেছন গেলাম । নদীর ঘাটটাও ফাঁকা কেউ নেই । এদিক সেদিকে ভাঙা মাটির হাড়ি, পাতিল , কলসি পরে আছে । বাম পাশের একটা গাছ থেকে কুরকুর করে একটা অচেনা পাখি ডেকে উঠতেই আমরা চমকে উঠলাম । একবার মনে হলো ঝেড়ে একটা দৌড় মারি । আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মামা বললেন- আমার এখন মনে হচ্ছে, সজল তোদেরকে ফাঁকি দিয়েছে । ও এদিকটায় আসেইনি । আমি বললাম -হতেই পারেনা মামা, ওতো আমাদের সবার চোখের সামনে দিয়ে এদিকে আসলো ।
– আসলো তো আমিও দেখলাম । কিন্তু তাহলে গেল কৈ ?
– কোন বিপদ আপদ হয়নি তো ? ফিরোজ ফিসফিস করে বলল । ঠিক এমন সময় মামা বলে উঠলেন – ঐটা কে রে ? সঙ্গে সঙ্গে আমি আর ফিরোজ চমকে উঠে মামার দেখানো হাত বরাবর লাশ পোড়ানোর বেদিটার দিকে তাকালাম । তাকিয়ে কিছু দেখতে না পেয়ে ফিরোজ বলল কোনটা মামা ?
– ঐ যে বেদিটার বামপাশের রডটার কাছে বসে আছে । আমার বুকের ভেতরটা তখন ধকধক করছে । হাত পা’গুলো ঠকঠক করে কাঁপছে । মনে হলো জ্ঞান হারিয়ে পরে যাবো । ভাল করে তাকিয়ে দেখি সত্যিই কে যেন হাঁটুতে ভর দিয়ে বেদীটায় বসে আছে । মামা জোড়ে জোড়ে বললেন – কেরে, কে ওখানে ? কেউ উত্তর দিল না । মামা এবার এগুতে লাগলেন । আমরাও ঘোরের মধ্যে মামার পেছন পেছন যেতে লাগলাম । বেদীর কাছে ছাঁয়াটার কাছাকাছি হতেই সেটি আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ালো । দেখে মনে হলো না, কোন তারা আছে । মামা আবারও বললেন- কে ? কে ওখানে ?
আমার কাছে মনে হলো, কে যেন নাকি স্বরে উত্তর দিল – আমি?
– আমি কে ? মামা আর একটু জোড়ে জিজ্ঞেস করলেন । ছাঁয়াটা প্রথমে কিছু না বললেও হঠাৎ ঘোৎঘোৎ শব্দ করে বলে উঠল তুই কে রে শুয়োর ? আমাকে জিজ্ঞেস করিস আমি কে ? আমরা চমকে উঠলাম । কেননা ছাঁয়াটা চোখের পলকে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে । হালকা পাতলা শরীরে লাল টকটকে টু-টো চোখ । আমার জ্ঞান হারিয়ে ফেলার দসা হলো । মনে হলো আমি বুঝি ভয়েই মরে যাবো । হঠাত করেই যেন চাঁদটা আবার মেঘের আড়ালে চলে গেল । আমি আর ফিরোজ মামার জন্য অপেক্ষা করলাম না – ওরে মাগো বলে ঝেড়ে দৌড় মারলাম গেটের দিকে । টের পেলাম মামাও আমদের সঙ্গে দৌড় লাগাল । আমরা গেটেই কাছে আসতেই ধুমধাম বিকট শব্দ করে গেটটা বন্ধ হয়ে গেল । আমরা তিনজন আছড়ে পড়লাম গেটের উপড় । ভয়ে আমি জ্ঞান হারা হয়ে গেছি । গেটের মধ্যে দু’হাত দিয়ে আঘাত করতে করতে হিস্টিরিয়ার রোগির মতো দরজা খোলার জন্য চিৎকার করতে লাগলাম । পেছন ফিরে দেখি ছাঁয়াটা হাসতে হাসতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে । আমরা যা যা বলে চিৎকার করতে লাগলাম । কিন্তু ছাঁয়াটা বাতাসে ভেসে ভেসে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতেই লাগল । মনে মনে ভাবলাম আজই বুঝি জীবনের শেষ দিন । হে আল্লাহ, মাফ করে দাও । মাফ করে দাও , বলে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম । ছাঁয়াটা আমাদের কাছ থেকে যখন হাত তিনেক দূরে, ঠিক সে সময় কে যেন খুব গম্ভীর গলায় বলে উঠল – দাঁড়া ? টোন্ট মুভ । সঙ্গে সঙ্গে ছাঁয়াটা থেমে গেল । আমি চমকে তাকিয়ে দেখি নদীর কাছে ভাঙা হাড়িগুলোর কাছে আরেকটা খুব লম্বা ছাঁয়া দাঁড়িয়ে আছে । ছাঁয়াটা লম্বা একটা আলখাল্লা পরে আছে বলে আরো লম্বা লাগছে । চুলগুলো কানের দু’পাশে পরে আছে । ছাঁয়াটার হুকুমে আমাদের দিকে আসতে থাকা ছাঁয়াটা থেমে গিয়ে ভয়ন্কর ভাবে গোৎগোৎ শব্দ করতে করতে হুকুমকারীর দিকে ছুটে গেল । কিন্তু হুকুমকারী ছাঁয়াটার দিকে দু’হাত উপরে তুলেতেই ছাঁয়াটা ছিটকে এক দিকে পরে গিয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল । আমরা এবার হুকুমকারী ছাঁয়াটার দিকে তাকালাম – দেখলাম ছাঁয়াটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে । আর ঠিক সে সময় ঘটাং করে গেটটা খুলে গেল । আমরা আর দাঁড়ালাম না ঝেড়ে দৌড় লাগালম । এক দৌড়ে কর্টন মেলের গেটে । কর্টন মেলের ঘেটে আসতেই দেখি রতন ওর বাবা-চাচাদের ডেকে এনেছে সবাই মিলে – শ্মাশানে যাবার জন্য প্রস্তুত হোচ্ছিল। আমরা ফিরে আসায় সবাই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো । সজল কোথায় জিজ্ঞেস করাতে রতন বলল- ও ওর বাসাতেই আছে । ওর বাবার সঙ্গে আমার আব্বুর কথা হয়েছে । ও বাসায় গেল কি ভাবে ? জিজ্ঞেস করতে রতন কিছু বললো না । বলল কাল কথা হবে । এখন বাসায় যা । পরিশেষ : পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মার কাছে শুনি, সজল এসেছে । ড্রয়িং রুমে বসে আছে । আমি ড্রয়িং রুমে ছুটে গেলাম । ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি ছোট মামা সজলের সঙ্গে কথা বলছেন । আমাকে দেখে সজল উঠে দাঁড়াল । আমি বললাম – তুই ঠিক আছিস তো সজলা ? সজল মাথা নেড়ে পকেট থেকে দু’শো টাকা বেড় করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল – আমায় মাফ করে দে, আমি কাল রাতে ভয়ে তোদের কাছে আসতে পারিনি । খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম । এ্যই নে তোদের বাজির দু’শো টাকা । আমার তো আক্কেল গুরুম সজলা বলে কি ? তাহলে গতরাতে আমরা কার জন্য শ্মশান ঘাটে গেলাম ? কেই বা আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে শ্মাশান ঘাটে গেল ? তাহলে কি ওটা সজল ছিল না ? ছিলো অন্য কেউ ??