Mr Cool | মিস্টার কুল | Ziaul Faruq Apurba | Tasnia Farin | Mehedi Hasan Jony | New Natok 2022
Jannat
31 Aug, 2022
আমার শাশুড়ির মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। তিনি একটু পর পর আমার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলছেন,
-- ওরে, দুশ্চরিত্রা মাগী ঢুকছে আমার ঘরে। ওরে তাড়াতাড়ি খ্যাদা । আমার ছেলের কপাল ভাঙছে। আমি ওর মুখ দেখতে চাই না।
আমি বিছানায় বসে সেই চিৎকার আর কান্নার শব্দ শুনছি। তীব্র লজ্জায় আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, শরীর কাঁপছে । আমি লুকিয়ে আছি আমার ঘরে। রাগ করতে পারছি না কারণ তিনি যে ঘটনা ইঙ্গিত করছেন তা পুরোপুরি ভুল নয়। আমার খুব ইচ্ছে করছে সত্যি সত্যি এক দৌড়ে এই বাড়ি ছেড়ে বাইরে চলে যেতে। সেটাও সম্ভব না, কারণ আমার আব্বাকে খবর দেয়া হয়েছে। আব্বা আসা পর্যন্ত আমায় অপেক্ষা করতে হবে। সবাই সালিশ শেষে বাড়ি পাঠাবে আমায় ।
আমি মৌমিতা। বয়স উনিশ। এই বছর
উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। মেডিকেল, ভার্সিটিতে ভর্তি হবার কথা ছিল আমার। তার পরিবর্তে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো আমাকে। নিরুপায় আমি কাউকে সত্য লুকিয়ে ঠকাতে চাইনি বলে প্রতিবাদ করেছিলাম। ফলস্বরূপ আব্বা আমার পিঠে প্রচণ্ড এক লাথি বসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,
,... হারামজাদির সাহস কত বড় , কুকর্ম করে আবার মুখে মুখে তর্কও করে দেখি ।
আব্বার দোষ নেই। আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। অথচ মাত্র কিছুদিন আগেই ভয়ংকরতম দুর্ঘটনাটি ঘটে গেছে আমার জীবনে। আমি সবার স্বপ্ন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছি। কেবল বড় মামা বিড়বিড় করে বললেন,
-- এখন বিয়ে দেয়ার কাম নাই। সময় দাও। ভুল মানুষই করে। লেখাপড়া শেষ করুক। ওরে ঢাকায় ওর বড় খালার কাছে পাঠায় দাও।
আব্বা তাতে রাজি হলেন না। তিনি এখন আর আমায় বিশ্বাস করতে পারছেন না।
আমি দেখতে বরাবরই সুন্দরী ছিলাম। কৈশোরে পা দিতেই অসংখ্য মুগ্ধ চোখ আমায় ঘিরে রাখতে শুরু করেছিল। অল্প বয়সের মাতাল আবেগে ভেসে গিয়ে শরীর, মন উজার করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম তাদেরই একজনকে । বুঝতে পারিনি ভুল মানুষকে বেছে নিয়েছিলাম আমি । যখন বুঝতে পারলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মানুষটি আমায় ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। গোপনে আমাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি, ভিডিও তুলে রেখেছিল সে । ভুল শুধরানোর উপায় ছিল না আমার তবে ফিরে আসার পথ খোলা ছিল। আমি ফিরে আসতেই চেয়েছিলাম । আর সেটাই আমার জন্য কাল হলো।
ঘটনা জানাজানি হবার পর আব্বা আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিলেন। আমার কুৎসিত অতীতকে মাটি চাপা দিতে আব্বা, চাচা আর মামারা মিলে বিস্তর পরিকল্পনা করতে লাগলেন প্রতিদিন ।
অবশেষে আমার বিয়ের ব্যাপারে তারা একমত হলেন। সফলও হলেন হয়ত কেননা ঘটনা চেপে একদিন আমার বিয়ে হয়ে গেল। ছেলের নাম শাহেদুল হোসেন তালুকদার । বাড়ি নেত্রকোনা। তালুকদার বাড়ির বড় ছেলে, দেখতেও ভদ্র, লাজুক প্রকৃতির। শীঘ্রই নাকি দেশের বাইরে যাবে এম, এস করতে। ছেলেপক্ষ আমায় দেখতে এসেছিল পছন্দ হওয়ায় সেদিনই বউ করে নিয়ে গেল ।
শহরে ওদের দোতলা বাড়ি । শ্বশুররা দুইভাই। যৌথ পরিবারে একসাথেই চলে তাদের রান্না, খাওয়া। নিজের ইচ্ছায় বিয়ে না করলেও মানিয়ে চলতে শুরু করেছিলাম আমি । তবে শেষ রক্ষা হলো না। এত সতর্কতার পরেও গতকাল দুইমাসের মাথায় কিভাবে কিভাবে যেন সব জানাজানি হয়ে গেল। হবে যে সেটা আমিও জানতাম। কেবল আব্বাকে সেটা বিশ্বাস করাতে পারিনি।
এরপর গত চব্বিশ ঘণ্টায় ঘৃনা আর অবজ্ঞা ছাড়া আমি এ বাড়ির কারো কাছ থেকে আর কিছুই পাইনি । আমার স্বামী শাহেদ যে গতকালও ভালোবাসি বলে বলে মুখে ফেনা তুলেছিল আজ চরম ঘৃণায় আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভোর থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যাওয়ার আগে তার দৃষ্টি, চোখমুখ দেখে আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন কোনো মানুষ নই। নোংরা, আবর্জনা জাতীয় কিছু।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন উর্মি আপা। তিনি আমার বড় চাচা শ্বশুরের একমাত্র আদরের মেয়ে। বাচ্চা হবে বলে বড়চাচা তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন। কিছুদিন হলো তিনি এ বাড়িতেই থাকছেন। আপা আমার চোখে চোখ রাখলেন । এই একটা মাত্র মানুষের চোখে আমি কোনো রাগ, ঘৃণা দেখতে পেলাম না। উর্মি আপা ঘরে ঢুকেছেন হাতে ভাতের থালা নিয়ে।
-- না খেয়ে থেকে তো মরে যাবি মৌমিতা । হা কর তো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
--আমি কিছু খাব না আপা । খেতে ইচ্ছে করছে না। উনি কোথায় গেছেন আপা ?
উর্মি আপা ভাত মাখাতে মাখাতে থমকে গেলেন । তার মুখটা কেমন মায়াময় দেখাতে লাগলো । বিষন্ন গলায় বললেন,
-- তোর বরের কথা বলছিস ? আচ্ছা আমরা মেয়েরা এত সহজে ভালোবেসে ফেলি কেন বলত?
এই যে তুই গতকাল থেকে না খেয়ে আছিস সে কি একবারও তোর কথা ভেবেছে ? উল্টো খবর পাঠিয়েছে তুই না যাওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না।
-- ও আচ্ছা। আব্বা কখন আসবে বলতে পার আপা ?
-- খবর দেয়া হয়েছে। আমার ধারণা চলে আসবে কিছুক্ষনের মধ্যে।
বলতে বলতে উর্মি আপার গলা ধরে আসে । আমি অবাক হয়ে দেখি উনার চোখে পানি। তিনি কান্না লুকাতে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমার চলে যাবার কথায় এখনও এ বাড়ির কেউ কাঁদতে পারে আমার ধারণায় ছিল না। কিছু কিছু মানুষের হৃদয় অসম্ভব কোমল, কেবল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকে হয়ত ।
-- আচ্ছা আপা, আমায় দেখে তোমার ঘৃণা হচ্ছে না?
গতকাল থেকে এত অপমান আর বঞ্চনার স্বীকার হয়েছি,..মানুষের এমন সব রূপ দেখেছি যে এখন আর কেউ আমায় ভালোবাসতে পারে বিশ্বাস হয় না।
উর্মি আপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ঘটনা মিথ্যা নয়, কিছুক্ষন আগে শ্বশুরসাহেব আমার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিলেন, "জেলে দেয়া উচিত এদের সব ক'টাকে। বদের বদ, সাহস কত ! এত বড় ঘটনা গোপন করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে !".. সেটা তিনিও শুনেছেন।
-- জানো আপা, এ বাড়ির অনেকের ধারণা আব্বা আমায় নিতে আসবেন না। বিয়ে দিয়ে তিনি বেঁচে গেছেন। তবে আমি জানি তিনি আসবেন। হাজার হোক, নিজের মেয়ে তো! আমি উনার সব স্বপ্ন হত্যা করেছি কিন্তু তবুও তিনি আমায় ফেলে দিতে পারবেন না।
নিজে হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। একজন খবর দিল আব্বা এসেছেন। আমার ডাক পড়ল নীচের তলার বৈঠকখানায়। সেখানে বিচার মতো বসেছে। ঘরে ঢুকে আমার সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে এলো। দেখলাম আব্বা, আমার শ্বশুরের পা জড়িয়ে বসে আছেন। কাকতি মিনতি করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছেন তার কাছে । অনুনয় করছেন আমায় মেনে নিতে। আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল।
চাচাশ্বশুর আমাকে দেখে গম্ভীর মুখে বললেন,
-- মিতা, ঝামেলা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। তুমি কাপড়চোপর গুছিয়ে এখনই তোমার বাবার সাথে চলে যাও। বোঝাবুঝির আর কিছু নেই।
আমি চুপচাপ উপরে চলে এলাম। আব্বার উপর বড্ড রাগ লাগছে। লাভ হবে না জেনেও কেন যে তিনি এদের দয়া ভিক্ষা চাইতে গেলেন ! কাপড় গুছিয়ে নীচে না নেমে ব্যাগ হাতে চলে এলাম ছাদে। শাহেদের সাথে এই দুই মাস প্রায় প্রতি বিকালে আমরা ছাদে বসে চা খেয়েছি। কী অদ্ভুত কাণ্ড, এত অপমানের পরেও চলে যাবার সময় এই বাড়ির প্রতিটি ইট, কাঠের জন্যও কেন যেন হাহাকার জাগছে মনে।
হয়ত এই মায়ার কাছেই মেয়েরা হেরে যায় বারবার। আমি ছাদে রেলিং ঘেষে দাঁড়ালাম। বাড়িটি তিন তলা করার কথা ছিল। নীচে একপাশে ইট, সিমেন্ট, লোহা লক্কর রাখা। মনে হলো এখান থেকে একবার লাফ দিয়ে পড়তে পারলে সব ঝামেলা চিরতরে শেষ হয়ে যাবে । আমার হঠাৎ সব ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে বড্ড ইচ্ছে করতে থাকে । আমি মন্দ্রমুগ্ধের মতো রেলিং বেয়ে উপরে উঠে পড়ি । আমার কেমন শান্তি শান্তি লাগে, আর মাত্র কয়েক মুহূর্ত। হঠাৎ একটা মমতাময়ী হাত খপ করে টেনে ধরে নীচে নামিয়ে আনে আমায় । আমি ঝাপিয়ে পড়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকি তার বুকে।
-- মরতে চাইছিলি তাই না ? লাভ কী হতো তাতে?
-- আপা আমার বাঁচার ইচ্ছে শেষ হয়ে গেছে। আমার জন্যই আজ আমার বাবাকে কতখানি নীচু হতে হলো তুমি দেখেছ ?
উর্মি আপা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দেন।
-- আচ্ছা সব দোষ কেবল মেয়েদের আর তার পরিবারকে বহন করতে কেন হয় বল তো! মেয়েরা কেন ঘুরে দাঁড়াবার সাহস করতে পারে না? ফিরতে পারে না ?
-- আমি তো পাপি, কলঙ্কীনি । এই সমাজ কি আমার ফেরা মেনে নিবে আপা ?
আপা মৃদু হাসেন।
-- একটা ডিভোর্স, কিছু ছবি কিংবা ভিডিও কোনোটারই এতো শক্তি নেই যে একটা মূল্যবান জীবনকে হারিয়ে দেয়। । আর সমাজের কথা বলছিস? না মেনে নিয়ে উপায় কী বল, যেখানে স্রষ্টা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ফেরার সময় রাখেন।
-- আমি ব্যাগ হাতে সিঁড়ির দিকে এগুতে থাকি। উর্মি
আপা শক্ত করে আমার হাত ধরে রাখেন।
-- মিতা, একটা কথা রাখবি? নতুন করে আবার পড়া শুরু করবি তুই। এবার বাঁচবি নিজের জন্যই, আমায় কথা দে।
আমি আপার হাত ধরে গাড়িতে উঠে বসি। শেষ মুহূর্তে কেন যেন শাহেদকে একবার দেখতে আমার বড্ড ইচ্ছে করে। আমি অতি কষ্টে সে ইচ্ছেকে বুকে চাপা দিয়ে নিজের মনকে বলি, 'আপা ঠিকই বলেছেন। এবার আমায় জয়ী হতেই হবে।'
****
"ম্যাডাম ইমার্জেন্সি পেশেন্ট। তাড়াতাড়ি আসতে হবে । কীটনাশক খেয়েছে। অবস্থা খারাপ।"
যে মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে তার বয়স বড়জোর ১৭/১৮। দ্রুত তার স্টমাক ওয়াশ করা প্রয়োজন । আমি মেয়েটির বাবা, মার খোঁজে তাকালাম। আশ্চর্য ব্যাপার, মেয়েটির সাথে তারা কেউই নেই ! মধ্য বয়সী এক মহিলা আর তার কিশোর ছেলে দাঁড়িয়ে আছে পাশে ।
মহিলা কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন,
-- আমার ভাই ঝি হয়।
-- কীটনাশক খেয়েছে ?
-- জি,মেয়ের ঘটনা আছে ।
-- কী ঘটনা?
-- এক পুলার লগে প্রেম আছিল। কিসব খারাপ ছবি নাকি আছে হের লগে । ঝগড়া বাইজা ছেড়া সব ছাইড়া দিছে ফোনে । শরমে ছেড়ি বিষ খাইছে। বাপেও আর ঘরে তুলব না কইছে।
--আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি আপনারা বাইরে গিয়ে একটু দাঁড়ান।
আমি মেয়েটির কাছে ফিরলাম । ওর স্টমাক ওয়াশ করা শেষ হয়েছে। শুয়ে আছে বিছানায়।
মেয়েটি একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল । কান্নার দমকে বার বার ওর শরীর কেঁপে উঠছে।
-- নাম কী তোমার ?
-- সালেহা।
-- কেন মরতে চেয়েছিলে বলো তো মেয়ে ?
-- আমার জীবন শেষ আপা। এই সমাজে মুখ দেখাইতে পারব না আর।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম ।
--শোন বোকা মেয়ে, সব দায় শুধু শুধু কেবল নিজের উপর নিচ্ছ কেন বলো তো ! ছেলেটির কোনো দোষ নেই? প্রতিবাদ কেন করছ না ?
-- আমার পাশে কেউ নাই আপা।
আমি নরম স্বরে বললাম,
'মানুষ যে জায়গায় সব হারিয়ে একা হয়ে যায়, কেউ না থাকলেও সৃষ্টিকর্তা ঠিক সে জায়গায়ই তার পাশে এসে দাঁড়ান। ভুল শুধরে ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ করে দেন,.. জানো সেটা ? '
মেয়েটি অবাক হয়ে তাকাল। আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম,
শোন সালেহা, জীবন অনেক মূল্যবান। আর শরীরও এতো সস্তা নয় যে একটা ভুলের জন্য তা নস্ট হয়ে যাবে চিরদিনের মতো । ফেরার পথ খোলা থাকে সব সময়ই। জেতা থেকে জিততে পারে সবাই। কিন্তু হারা থেকে জিততে পারে কয়জন বলো তো ? যারা পারে তারা কোনো সাধারণ মানুষ নয়।
মেয়েটি চোখ মুছে চুপ করে থাকে।
আমি হাল্কা স্বরে বলি,
-- আজ থেকে নতুন জীবন শুরু করবে তুমি । নতুন এ জীবন কেবল তোমার নিজের জন্য হবে , নিজের জিতবার জন্যই কেবল।
মেয়েটির বোবা চোখে তাকিয়ে থাকে । আমি চুপচাপ হেঁটে হাসপাতালের বাইরে করিডোরে এসে দাঁড়াই। এখন রাত, বাইরে অন্ধকার। রাতে গ্রামের রাস্তাগুলো অন্ধকার থাকে জেনেও ভুলে সাথে টর্চ আনা হয়নি আজ । তবে আকাশে বিশাল বড় চাঁদ উঠেছে। আমি সেই চাঁদের আলোয় পথ চলতে থাকি ।
..প্রকৃতির সাথে এক জায়গায় মানুষের জীবনের একটা অদ্ভুত মিল আছে । মানুষের জীবনে যখন অন্ধকার নেমে আসে চাঁদেরই মতো কিছু মানুষ তখন আলো হয়ে পথ দেখায়। যেমন আজ থেকে 'দশ বছর' আগে প্রচণ্ড এক অন্ধকার সময়ে উর্মি আপা নামের একজন আলোকিত মমতাময়ী মানুষ আমায় পথ দেখয়েছিল। সেদিন প্রতারিত হয়ে, ডিভোর্সির তকমা গায়ে লাগার পরও দুমড়েমুচড়ে যাওয়া এই আমি থেমে যাইনি । সাহস সঞ্চয় করে নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। মানুষের ফেরার সুযোগ কখনো শেষ হয় না। এক সময় আমাকে মেয়ে বলে পরিচয় দিতে অস্বীকার করা মানুষগুলোই আজ গর্ব করে বলে ডাক্তার ইয়াসমিন মৌমিতা আমার মেয়ে।
হ্যাঁ, আমি ডাক্তার ইয়াসমিন মৌমিতা, মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে এই দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার হিসেবে যোগদান করেছি বছরখানেক হলো। হঠাৎ হঠাৎ এখানে সালেহার মতো কিছু মেয়ে আসে। যাদের মাঝে নিজের ছায়া দেখতে পাই আমি। অতীত জীবনের সাথে অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই ।
নিজেকে হারিয়ে ফেলা, ভেঙে নুইয়ে যাওয়া এইসব মেয়েদের আমি আমার জীবনের গল্পটা শুনাই । বলি,.. আমি আমার মতো করে জীবনে ফিরেছি। তারাও ফিরবে তাদের মতো করেই। তারা বিস্মিত হয়ে শুনে আমার সেই লড়াইয়ের গল্প।
জিতে যাবার গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে..?
আমারও ভালো লাগে বলতে।
আমি আনন্দিত মুখে অবিকল উর্মি আপার মতো মাথা নেড়ে তাদের বলি… তাদের বুঝাই,
"শরীর তো এমন ঠুনকো নয় যে কারো প্রতারণা বা মিথ্যা স্পর্শে তা চিরজীবনের মতো নষ্ট হয়ে যাবে । জীবন অনেক সুন্দর , অনেক মূল্যবান। একটা ডিভোর্স, কতগুলো ছবি, ভিডিও এর তুলনায় অতি ক্ষুদ্র, তুচ্ছ বিষয় । এসব ক্ষুদ্র জিনিসের কী সাধ্য এই বিশাল জীবনকে মাঝ পথে থামিয়ে দেয় ? যেখানে স্বয়ং স্রষ্টা তার বান্দাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমা করতে প্রস্তুত থাকেন ।"
# ফেরা
#মাহবুবা আরিফ সুমি